রাজশাহীর দামকুড়া গ্রামের স্বপ্না মারান্ডি। স্বামী ও দুই সন্তানের সাথে তার বসবাস। বলছিলেন করোনার এই দুঃসময়ে পাড়ি দেয়া ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।
স্বপ্না মারান্ডি বলেন, অবস্থা একদম মরণদশা। কালকে কিস্তি কি করে দেব? অনেক কষ্ট পাচ্ছি। কালকে কিস্তির লোক এসে বলবে আপনাকে যেভাবেই হোক কিস্তির টাকা দিতেই হবে। এই নিয়ে সমস্যাই আছি।
ঐ গ্রামের বেশিরভাগ আদিবাসীর অবস্থা মারান্ডির মতোই। করোনায় কর্মহীন হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে চলছে তাদের দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের চাহিদা মেটানো ও নানা সংকট মোকাবিলার যুদ্ধ।
করোনার পর থেকে খাবার খুব কষ্ট। টাকা-পয়সার সমস্যায় আছি।
এখন যেহেতু কাজ-কাম নাই, খাবারও মজুদ নাই, এটার জন্যই খাবারের একটু সমস্যা হচ্ছে।
নানান ভাষা, বুলি ও জাতিগত আচারের বাংলায় বাঙালির পাশাপাশি সমাবেশ ঘটেছে, এসব আদিবাসী জাতির। ভিন্ন জীবনধারা, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি আর অনন্য শিল্পশৈলির অফুরান সংমিশ্রণে ঘেরা এই সকল জনগণের সাংবিধানিক পরিচয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি। এদের রয়েছে জীবন ধারণের সক্রিয় সমাজ ব্যবস্থা। রয়েছে নিজস্ব ভাষা। বর্তমানে সেসব চর্চায় বাঁধ সেধেছে করোনা।
কোনো বাচ্চারাই পড়াশোনা করতে চাইছে না বাড়িতে। হয়তো বাবা-মা বাধ্য হয়ে বসাচ্ছে, তখন হইতো পড়ছে। তাছাড়া ছোট কিংবা বড় কেউই নিজে থেকে পড়াশোনা করতে বসছে না।
এই করোনা ভাইরাসের জন্য আমাদের শিশুরা পিছিয়ে পড়েছে। আমাদের মাতৃভাষায় যে অক্ষর জ্ঞানগুলো শিখতো বা আমাদের যেসব ভাষা হারিয়ে যাচ্ছিলো… সেগুলো আবার পুনরুদ্ধার করে আবার তাদের শেখাচ্ছিলাম। এগুলো থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। যতটুকু এগিয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি পিছিয়ে গেলাম।
সমতলের এসব জাতিসত্তার ৯০ শতাংশ মানুষই ভূমিহীন। প্রধান পেশা কৃষি। নারী পুরুষ উভয়েই কাজ করেন মাঠে। বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে ফসল লাগানো বা কাটার মতো পরিশ্রম করলেও তাদের ৭৮ শতাংশ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন। দিনমজুরির কাজ কমে যাওয়ায় করোনা অতিমারিতে বিপাকে পড়েছেন তারা।
আদিবাসীরা বেশিরভাগই কাজের জন্য বাইরে যায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, এখন অধিকাংশ আদিবাসী ঘরে বসে আছে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারছে না। কাজ-কর্ম পাচ্ছে না। কোথায় থেকে খাওয়া-দাওয়া করবে। তার উপরে অসুখ-বিসুখের জন্যও তো টাকা-পয়সা লাগে। কোথায় পাবে এগুলোর জন্য টাকা?
করোনা কালে তাদের জীবনের বাস্তবতা বিশেষভাবে দেখতে দরকার বাড়তি মনোযোগ। বলছেন আদিবাসী সংস্থা ও নেতারা।
মাসাউসের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মেরিনা হাজদা বলেন, আমাদের জাতি-গোষ্ঠির লোকেরা কাজের উপর নির্ভরশীল। এবং যদি কাজ না থাকে তাদের তাহলে কিন্তু তারা খেতে পায় না। দিন আনে দিন খায়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে যখন কাজ বন্ধ হয়ে গেলো, তখন খুবই সংকটময় সময় পার করেছে তারা এবং খুব করুণ অবস্থায় গেছে। সেই জায়গা থেকে কিছু তারা সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছে। সেটা অপ্রতুল।
নানাভাবে সহায়তার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়ে জনপ্রতিনিধি জানালেন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বোধ যত বাড়বে ততই ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।
রাজশাহী-২ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, দারিদ্রসীমার নিচে চলে গেছেন। তাদের সামনে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে খাদ্য। এবং আজকে সরকারকে খাদ্য নিরাপত্তা প্রশ্নটা গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। স্বাস্থ্যখাতে তো আমাদের একটা ব্যর্থতা আছেই। এখন খাদ্য নিরাপত্তা মানুষকে দিতে না পারলে, এই ব্যর্থতা কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশ তৈরী করবে।
উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলে সাঁওতাল, পাহাড়িয়া, মুন্ডা, ওঁরাও, কোচ, মাহাতো, মালো, হুঞ্জার, মাহালি, মুসহর, তরি, রাজবংশি ও অন্যান্য জনগোষ্ঠির বসবাস।
এসব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠি আমাদের সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ধারণ করছে। করোনা মহামারিকালেও এসব জনগোষ্ঠির মানুষেরা পাচ্ছে না বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা, যা তাদের জীবনযাত্রাকে করে তুলেছে আরো দুর্বিষহ।